শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৯:৫৬ পূর্বাহ্ন

নোবেলের যত কথা

নোবেলের যত কথা

স্বদেশ ডেস্ক:

পৃথিবীতে পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত পুরস্কার হিসেবে ধরে নেওয়া হয় নোবেলকে। সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার এটি। তবে এই পুরস্কারের পেছনেও রয়েছে নানা ঘটনা। আমাদের আজকের আয়োজন নোবেল পদকের আলোচিত ঘটনাবলি নিয়ে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন- আজহারুল ইসলাম অভি

নোবেল পদক গ্রহণ করেননি যারা

নোবেলকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত পুরস্কার হিসেবে গণ্য করা হয়। ওই পুরস্কার পেয়েও ফিরিয়ে দেবেন- এমনটি ভাবা যায়! বিষয়টি বিস্ময়কর হলেও এমন ঘটনা ঘটেছে। শুধু তা নয়, পুরস্কার নিয়েছেন কিন্তু পুরস্কারের অর্থমূল্য নেননি- এমন ঘটনাও বিরল নয়। অর্থাৎ নোবেল নিয়ে ঘটনার ঘনঘটা একেবারে কম নয়। ১৯৬৯ সালের ২৩ অক্টোবর আইরিশ লেখক স্যামুয়েল বেকেট ও তার স্ত্রী সুজান তিউনিসিয়ায় ছুটি কাটাতে গেলে হঠাৎ একদিন একটি টেলিগ্রাম পান। বেকেটের ফ্রেঞ্চ প্রকাশক টেলিগ্রামে লিখেছেন, ‘আপনি বাসায় লুকিয়ে থাকবেন, প্লিজ।’ তিনি বাক্যটি পড়েই ঘাবড়ে যান। কারণ তিনি তো কোনো অপরাধ করেননি। লুকিয়ে থাকবেন কেন? কিন্তু আসল খবর বেশিক্ষণ চাপা থাকে না। মুহূর্তেই জানাজানি হয়ে যায়, তিনি ওই বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এর পরই ঘটে মজার ঘটনা। তিনি প্রথমে পুরস্কার গ্রহণে অনীহা দেখান। তবে স্ত্রী তাকে বোঝাতে সক্ষম হন, আয়ারল্যান্ডের জন্য হলেও এ পুরস্কার তার গ্রহণ করা উচিত। কেননা এ তো দেশেরও সম্মান। স্ত্রীর কথা মেনে নিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেন ঠিকই কিন্তু প্রাপ্ত টাকা গ্রহণ করেননি। তিনি বলেন, অর্থ বৃদ্ধদের জন্য ব্যবহার করলে ভালো হবে। যাদের থাকার জায়গা নেই, খাবার খেতে পারেন না- এই টাকা তাদের। এখন পর্যন্ত দুই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন জ্যঁ পল সার্ত্রে। তিনি ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলে আনুষ্ঠানিক সম্মানের প্রতি অনীহা দেখিয়ে ওই বছর নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, নাট্যকার, সাহিত্যিক ও সমালোচক। তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন। নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করা দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন ভিয়েতনামের লে ডাক থো। ১৯৭৪ সালে আমেরিকার কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে যৌথভাবে ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত তার দেশে শান্তি ফিরে না আসায় নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। আবার উল্টো ঘটনাও ঘটেছে। ব্যক্তি আগ্রহী হয়েছেন। কিন্তু দেশ বাদ সেধেছে। চারজন নোবেল লরিয়েটের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটেছে। যেমন- হিটলার তিনজনকে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য করেছিলেন। তারা হলেন রিচার্ড কুন, অ্যাডলফ বুটেনান্ডট ও গার্হাড ডোম্যাক। পরে তারা নোবেল প্রাইজ ডিপ্লোমা ও মেডেল গ্রহণ করলেও পুরস্কারের টাকা পাননি। বরিস পস্তেরনায়েক ১৯৪৬-৫০ সাল পর্যন্ত নোবেলের শর্ট লিস্টে থাকলেও কোনোবারই ভাগ্য প্রসন্ন হয়নি। অবশেষে ১৯৫৮ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি এই পুরস্কার গ্রহণও করেন। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপের ফলে পুরস্কার প্রত্যাখ্যানে বাধ্য হন তিনি।

বিতর্কিত নোবেল

অং সান সুচি : মিয়ানমারের এই রাজনীতিক দেশটির সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৯১ সালে নোবেল পান। কিন্তু এর ২০ বছর পর তার দেশে রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। রাখাইনের ঘটনাকে জাতিসংঘ গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করেছে। এমনকি তার পদক প্রত্যাহারের দাবিও উঠেছে। তবে নিয়ম অনুযায়ী সেটি করা যায় না।

আবি আহমেদ : ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদকে নোবেল দেওয়া হয় ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সীমান্ত সংঘাত নিরসনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই এ পুরস্কারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ নিজে দেশের টাইগ্রের উত্তরাঞ্চলে সেনা মোতায়েন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। সেখানে লড়াইয়ে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়। জাতিসংঘ এটিকে ‘হৃদয়বিদারক বিপর্যয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

বারাক ওবামা : ২০০৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বারাক ওবামার নাম ঘোষণায় ধাক্কা খেয়েছিলেন অনেকেই। তার মধ্যে ছিলেন নোবেল বিজয়ী স্বয়ং ওবামাও। তিনি ২০২০ সালে নিজের স্মৃতিকথায় ওই ঘোষণার প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিখেছেন, ‘কিসের জন্য?’ তখন তার ক্ষমতায় আসার মাত্র ৯ মাস ছিল এবং সমালোচকরা তাকে মনোনয়নের সিদ্ধান্তকে ‘অপরিপক্ব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সত্যি কথা বলতে, ওবামার শপথ নেওয়ার ১২ দিনের মধ্যেই পুরস্কারের জন্য নাম জমা দেওয়ার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৫ সালে নোবেল ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক গের লান্ডেটস্ট্যাড বিবিসিকে বলেছিলেন- যে কমিটি ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ওবামার দুই মেয়াদের সময়কালে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধরত ছিল।

এ বছর নোবেল পেলেন যারা

রসায়ন : রসায়নে নোবেল পেয়েছেন দুই বিজ্ঞানী— বেঞ্জামিন লিস্ট ও ডেভিড ডাব্লিউ সি ম্যাকমিলান। অপ্রতিসম জৈব-অনুঘটন বিক্রিয়া আবিষ্কারের জন্য তাঁরা এ পুরস্কার পান।

পদার্থবিজ্ঞান : পদার্থবিজ্ঞানে এ বছর নোবেল পেয়েছেন তিন বিজ্ঞানী। তারা হলেন জাপানের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিদ সাইকুরো মানাবে, জার্মানির সমুদ্রবিজ্ঞানী ক্লাউস হাসেলম্যান এবং ইতালির তাত্ত্বিক পদার্থবিদ জর্জিও প্যারিসি। গত মঙ্গলবার নোবেল কমিটি তাদের নাম ঘোষণা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে পূর্বাভাস ও জটিল ফিজিক্যাল সিস্টেম নিয়ে কাজ করায় তারা এ পুরস্কার পেয়েছেন। নোবেল পুরস্কারের চার ভাগের অর্ধেক পাবেন পদার্থবিদ জর্জিও প্যারিসি। বাকি অর্ধেক সমানভাগে ভাগ করে নেবেন বাকি দুই বিজ্ঞানী।

শান্তি : এ বছর শান্তিতে সম্মানজনক এ পুরস্কার জিতেছেন মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ। ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ সময় বেলা ৩টায় নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করে নোবেল কমিটি।

সাহিত্য : এবার সাহিত্যে নোবল পেয়েছেন আবদুল রাজাক গুরনাহ। ৭ অক্টোবর সুইডিশ একডেমি নোবেলজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করে। জানজিবারে জন্ম নেওয়া আবদুল রাজাক গুরনাহ ইংল্যান্ডে সাহিত্যচর্চা করছেন। সুইডিশ একাডেমি বলছে, ঔপনিবেশিকতার প্রভাব নিয়ে তার আপসহীন ও সহানুভূতিশীল লেখনীর জন্য তাকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসা : চলতি বছর চিকিৎসায় বিশেষ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ডেভিড জুলিয়াস ও আর্ডেম প্যাটাপোসিয়ান। ৪ অক্টোবর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে কারোলিনসকা ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশ সময় দুপুরে এক অনুষ্ঠানে নোবেল কমিটি এই ঘোষণা দেয়। তবে চূড়ান্ত বিজয়ীদের নাম ঘোষণার আগে চিকিৎসায় নোবেলের জন্য মনোনীত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বা সংক্ষিপ্ত তালিকা সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি। ডেভিড জুলিয়াস শরীরতত্ত্ব ও আর্ডেম প্যাটাপোসিয়ান ওষুধের ওপর এই পুরস্কার পেলেন।

নোবেলের দাবিদার অথচ পাননি

মহাত্মা গান্ধী

১৯৩৭, ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে মহাত্মা গান্ধীজিকে (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী) মনোনীত করেছিলেন নরওয়েজিয়ান স্টর্টিংয়ের লেবার পার্টি সদস্য ওলে কোবিওর্নসেন। পর পর তিনবার মনোনীত হয়েও গান্ধী ১৯৩৭ সাল বা এর পরের দুই বছর নোবেল জেতেননি। এর পেছনের একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা হয় নোবেল কমিটির উপদেষ্টা প্রফেসর জ্যাকব ওয়ার্ম-মুলারের এক প্রতিবেদনকে। সেখানে গান্ধীর ব্যাপারে জেকবের মত ছিল- গান্ধীজি হয়তো অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ। ভারতের মানুষ তাকে অপরিসীম শ্রদ্ধা করে। কিন্তু তার বেশকিছু নীতিনির্ধারণের সঠিক কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী। অথচ একই সময়ে তিনি একনায়ক, আদর্শবাদী আবার জাতীয়তাবাদী। তিনি কখনো ঈশ্বর আবার কখনো সাধারণ রাজনীতিকের স্তরে নেমে আসেন। পরবর্তী দুই বছরেও তিনি পর পর মনোনয়ন পেলেও তার নাম শেষ বাছাই তালিকায় পৌঁছায়নি। আবারও তিনি মনোনয়ন পেয়ে শেষ বাছাই তালিকায় পৌঁছালেন প্রথম মনোনয়ন পাওয়ার দশ বছর পর। ১৯৪৮ সালে আবারও মনোনীত হলেন তিনি। মনোনয়নের সময়সীমা শেষ হবে ১ ফেব্রুয়ারি। আর ৩০ জানুয়ারির বিকালে গান্ধীর বুক ফুঁড়ে দিল নাথুরামের বুলেট। নিহত হলেন তিনি। তবু নোবেল কমিটির তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী বিশেষ ক্ষেত্রে মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়া যেতে পারত। শেষ পর্যন্ত তা আর করেনি নোবেল কমিটি।

টলস্টয়

লিও টলস্টয়ের নাম শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। ১৯০১ সালে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন লিও টলস্টয়। কিন্তু বিচারকরা তার নৈরাজ্যবাদ ও অদ্ভুত ধর্মীয় মতাদর্শের কারণে পুরস্কারের জন্য অযোগ্য মনে করেন। ১৯০২ সালে আবার মনোনীত হন। এবারও প্রত্যাখ্যাত হন। তার ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ও ‘আনা কারেনিনা’ বিশ্বসাহিত্যের সেরা দুটি উপন্যাস। যে কোনো একটিই পুরস্কার জেতার জন্য যথেষ্ট ছিল। না পাওয়ার পেছনে যেসব কারণ বলা হয়, এর একটি হচ্ছে তার লেখা আদর্শবাদী ছিল না- ছিল বাস্তববাদী। আরেকটি কারণ এবং সবচেয়ে জোরালো কারণ হতে পারে- সেটি রাশিয়া ও সুইডেনের মধ্যকার অনেক পুরনো দ্বন্দ্ব।

মার্ক টোয়েন

প্রথম ১০ বছরে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জোরালো দাবিদার। কিন্তু প্রতিবারই পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হন আমেরিকান উপন্যাসের জনক মার্ক টোয়েন। ‘টম সয়ার’ ও ‘হাকলবেরি ফিন’-এর মতো উপন্যাসগুলোর রচয়িতা, গদ্যকার, সমালোচক, হাস্যরস সম্রাটকে পুরস্কার না দিতে পারা নোবেল কমিটির অদূরদর্শিতার প্রমাণ।

নোবেল পদক চুরি

গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য ১৯১৩ সালে বাঙালির প্রথম নোবেল এনে দিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পদকটি রাখা হয়েছিল রবি ঠাকুরের নিজের হাতে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী জাদুঘরে। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে বাঙালির অর্জিত নোবেল পদকটি চুরি হয়ে যায়। ২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরায়নের রবীন্দ্র জাদুঘর থেকে রহস্যজনকভাবে ‘নোবেল পদক’সহ চুরি হয়ে যায় কবির ব্যবহার্য অন্তত অর্ধশত মূল্যবান জিনিস। অবাক হলেও সত্যি, ভারত সরকারের প্রায় সব গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নেমে তদন্ত করলেও গত ৯ বছরে এ চুরির কিনারা করতে পারেনি কোনো সংস্থাই।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877